“যা দেয় হালাইয়া, তা পাওয়া যায় কালাইয়া”—প্রবাদের সত্যতা খুঁজতে গেলে চোখে পড়ে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যকেন্দ্র কালাইয়া বন্দর। পটুয়াখালীর কালাইয়া ইউনিয়নে অবস্থিত এ বন্দরটি দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে এ বন্দরে ভারতীয়, পর্তুগিজ, ফিরিঙ্গি এবং বার্মার বণিকদের পদচারণা ছিল নিয়মিত। সময়ের পরিক্রমায় এটি আজও দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে।
বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র:
১০.৫৪ একর আয়তনের কালাইয়া বন্দরে প্রতি সপ্তাহে সোমবার বিশাল হাট বসে, যেখানে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা থাকে চোখে পড়ার মতো। এই বন্দরে গরু, মহিষ ও ধান বেচাকেনার জন্য বিখ্যাত। বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যাপারীরা গরু-মহিষ নিয়ে আসেন, যা কিনতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকাররা ছুটে আসেন।
ধানহাটেও থাকে জমজমাট কেনাবেচা। পটুয়াখালীর দশমিনা, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, ভোলার লালমোহন, চরফ্যাশন, বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখানের কৃষকরা ধান বিক্রির জন্য এখানে ভিড় করেন। স্থানীয় পাইকাররা এসব ধান কিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করেন।
এ বন্দরের মৎস্য ব্যবসাও প্রসিদ্ধ। দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে ধরা মাছ এখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।
ইতিহাসের পাতা থেকে:
১৩২০ খ্রিস্টাব্দে রাজা দনুজমর্দন দেব বরিশাল, ফরিদপুর ও খুলনার কিছু অংশ নিয়ে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান পটুয়াখালী ও ভোলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত তেঁতুলিয়া নদীর পশ্চিম পাড়ের কচুয়া ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। পরবর্তী সময়ে রাজকুমারী কমলা দেবী চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রানী হিসেবে সিংহাসনে বসেন। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ছিলেন মধ্যযুগের একমাত্র নারী শাসক।
কালাইয়া বন্দরের নামকরণ নিয়ে দুইটি জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, রানী কমলা দেবীর নিকটজন কালাই নামের এক ব্যক্তি বণিকদের জন্য এ বন্দরের জায়গা নির্ধারণ করেন, যার নাম অনুসারেই বন্দরের নাম হয় কালাইয়া। দ্বিতীয়ত, রানীর স্বামী বলভদ্র বসু ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের, তাই তাকে ‘কালা রাজা’ বলা হতো। এই ‘কালা রাজা’-র নাম থেকেই কালাইয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।
ঐতিহ্যের সাক্ষী স্থাপনাগুলো:
কালাইয়া বন্দরে রয়েছে ২৫০ বছরের পুরনো বড় পুকুর ও তার উত্তর পাড়ে অবস্থিত ২০০ বছরের পুরনো বড় জামে মসজিদ। পশ্চিম পাশে পাশাপাশি রয়েছে হাজী জামে মসজিদ ও আখড়া বাড়ি মন্দির, যা ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীক।
এছাড়া বন্দরের শত বছরের পুরনো লাল দালানের খাদ্য গুদাম, দরবেশ তমির উদ্দিন আওলিয়ার মাজার, রাজা জয়দেব বল্লভের কন্যা কমলা রানীর দিঘি এবং কালারাজার বিলসহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।
যোগাযোগ ও আবাসন সুবিধা:
ঢাকা থেকে নৌপথে সরাসরি কালাইয়া বন্দরে যাওয়া যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে এসে সকাল ৬-৭টার মধ্যে বন্দরে পৌঁছায়। এছাড়া সড়কপথেও পদ্মা সেতু হয়ে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায় কালাইয়া যাওয়া সম্ভব।
বন্দরে বিভিন্ন বাংলা খাবারের হোটেল ছাড়াও চাইনিজ খাবারের দোকান রয়েছে। থাকার জন্য তিন কিলোমিটার দূরে বাউফল উপজেলা শহর বা ৩৫ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে উন্নত হোটেল রয়েছে।
শেষ কথা:
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ব্যবসার এক অপূর্ব মেলবন্ধন কালাইয়া বন্দর। শতাব্দীপ্রাচীন এ বন্দর কেবল ব্যবসায়িক কেন্দ্র নয়, এটি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এবং ঐতিহ্যের ধারক। যুগ যুগ ধরে এটি দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যা ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।